শাইখ সিরাজ ভাই
আমাদের সামনে আছেন বলে
অনেক সময়ই আমরা তাঁর
সঠিক মূল্যায়ন করতে পারি না। কিন্তু
তাঁর কীর্তি এবং অবদান,
তাঁর জীবন, তাঁর প্রচেষ্টা
থেকে আমাদের অনেক কিছু
শেখার আছে।
এক নম্বর হলো
সাধনা, ঐকান্তিকতা। শক্তি
চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, কবির সকলি আছে,
একাগ্রতা নেই।আমাদের শাইখ ভাইয়ের একাগ্রতা
আছে। সেটা
খুব বড় কথা।
ডেভিড শেংক নামের
একজন লেখক আমেরিকায় একটা
বই বের করেছেন—বহু
গবেষণা করে। ‘দ্য জিনিয়াস ইন অল অব
আস’। তিনি
বলছেন, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে
আইনস্টাইন, পিকাসো, বেটোফেনের জিন আছে। আমরা সবাই জিনিয়াস। কিন্তু
প্রকৃত জিনিয়াসরা একটা বিষয়ে এত
মনোযোগ দেন, এত সাধনা
করেন, এত একান্ত চেষ্টা
করেন যে, তাঁর ওই
জিনটা সক্রিয় হয়ে ওঠে।
শাইখ সিরাজ ভাই
কৃষি নিয়ে একান্তভাবে সাধনা
করে গেলেন। ফলে কৃষি সাংবাদিকতায় তিনি
হয়ে উঠলেন একজন মহিরুহ।
দুই. কৃষিকে আমরা
সব সময় ভেবে এসেছি
‘খ্যাত’ জিনিস। আমাদের সংবাদপত্রগুলোতে কত বিভাগ আছে,
কিন্তু কৃষি নেই। অথচ বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান
দেশ। কৃষকের
দেশ কৃষির দেশ।
শাইখ সিরাজ ভাই
বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘মাটি ও মানুষ’
নামের অনুষ্ঠান করতে শুরু করেন। তারপর
তাঁরা যখন চ্যানেল আই
প্রতিষ্ঠা করলেন, তিনি শুরু
করলেন ‘হৃদয়ে মাটি ও
মানুষ’। এখনো
বিটিভিতে তিনি কৃষি-বিষয়ক
অনুষ্ঠান করেন। এর বাইরেও চ্যানেল আইতে
কৃষিসংক্রান্ত চিঠিপত্রের জবাবের অনুষ্ঠান, ঈদে
কৃষকের ঈদ আনন্দ, বাজেটের
আগে কৃষকের বাজেট ভাবনা-জাতীয় অনুষ্ঠান করেন। তিনি
চ্যানেল আইয়ের বার্তা বিভাগের
প্রধান। চ্যানেল
আইয়ের খবরেও কৃষি সংবাদ
থাকে। আবার
শিক্ষিত তরুণদের মাঠে নিয়ে গিয়ে
কৃষিকাজ করতে লাগিয়ে দিয়ে
তিনি করলেন রিয়্যালিটি শো। মানে
কৃষিও যে একটা ভালো
বিষয় হতে পারে, যা
একটা বেসরকারি চ্যানেলে প্রচার করা যায়,
সেই অনুষ্ঠানটিকে জনপ্রিয় করা যায়, তা
তিনি দেখিয়ে দিলেন।
তার ফলটা আমরা
পেলাম জাতীয়ভাবে। আজকে
বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আজকে
বাংলাদেশে মাছ চাষের বিপ্লব
ঘটে গেছে। পৃথিবীর
সেরা মৎস্য উৎপাদক দেশের
একটা আজ বাংলাদেশ।
পৃথিবীর সেরা ফল উৎপাদক
দেশের একটা বাংলাদেশ।
এসবের পেছনে সরকারের অবদান
আছে, কৃষকদের অবদান আসল, কিন্তু
শাইখ সিরাজকেও এর গৌরবের ভাগ
আমাদের দিতে হবে। তা যে কত
বড় কথা, আমরা কি
তা বুঝি।
শাইখ ভাই ক্ষতিকর
কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করে প্রাকৃতিক
উপায়ে কীটের আক্রমণ থেকে
ফসল রক্ষার সবুজ উপায়
জনপ্রিয় করার চেষ্টা করেন। দেশে
আর দেশের বাইরে যে
যেখানে কৃষিতে ভালো করছেন,
তা তিনি তাঁর অনুষ্ঠানে
দেখান। সেটা
বড় কুলই হোক আর
খেজুরের চাষই হোক। তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের
সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে
উপকূলের কৃষকেরা ভাসমান সবজি চাষ
করছে, তিনি তাও দেখান। অর্থাৎ
কিনা নতুন ধরনের কৃষিপদ্ধতি,
যা আমাদের পরিবেশকে রক্ষা
করবে, আবার উৎপাদনও বৃদ্ধি
করবে, তা প্রচারে ও
প্রসারে শাইখ সিরাজ নিরলসভাবে
কাজ করে যাচ্ছেন।
দেশে তিনি মাত্র
৩৯ বছর বয়সে পেয়েছেন
একুশে পদক। আন্তর্জাতিক
পরিমণ্ডলে তাঁর স্বীকৃতি আরও
বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের অশোকা ফেলো শাইখ
সিরাজ খাদ্য নিরাপত্তা ও
দারিদ্র্য বিমোচন বিষয়ে সাংবাদিকতায়
অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে
২০১৫ সালে পেয়েছেন আন্তর্জাতিক
ক্ষেত্রে মর্যাদাপূর্ণ ফিলিপাইনের গুসি শান্তি পুরস্কার। ২০০৯
সালে অর্জন করেছেন জাতিসংঘের
খাদ্য ও কৃষি সংস্থার
এ এইচ বুর্মা অ্যাওয়ার্ড। তিনি
পেয়েছেন ব্রিটেনের বিসিএ গোল্ডেন জুবিলি
অনার অ্যাওয়ার্ডস ও ব্রিটিশ বাঙালি
সংগঠনের গ্রিন অ্যাওয়ার্ড।
ব্রিটিশ হাউস অব কমনস
তাঁকে প্রদান করেছে বিশেষ
সম্মাননা। এ
ছাড়া পেয়েছেন অর্ধশত দেশি-বিদেশি
পুরস্কার ও সম্মাননা।
আর পেয়েছেন দেশের
মানুষের ভালোবাসা। ফেসবুকে
তিনি বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বর
একজন। রাস্তাঘাটে
তিনি হাঁটতে পারেন না,
মানুষ তাকে ছেঁকে ধরে। চ্যানেল
আইয়ে কী ভালো লাগে,
প্রশ্ন করলে উত্তর আসে—‘হৃদয়ে মাটি ও
মানুষ’।
তাঁকে রোজ দেখি,
কথা বলি, তাঁর পাশে
বসে চা খাই, এ
জন্য অনেক সময় তাঁর
বড়ত্বটা বুঝতে পারি না।
ভালোভাবে ভেবে দেখলে শাইখ
সিরাজ এক নীরব বিপ্লবের
নাম।
১৯৫৪ সালের ৭
সেপ্টেম্বর, এই দিনে তিনি চাঁদপুরে
জন্মগ্রহণ করেছিলেন।