অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম তথা ইসলামীক স্কলারদের মতে জিহাদ করা ফরজ তথা আবশ্যক কাজ। এটা একটা ইবাদাত।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
-তোমাদেরকে যুদ্ধ করার হুকুম দেয়া হয়েছে অথচ, তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়। হতে পারে তোমরা এমন কিছুকে অপছন্দ কর যা তোমাদের জন্য কল্যণকর। আবার এমনও হতে পারে কোন জিনিসকে তোমরা পছন্দ করো অথচ, তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ সবকিছু জানেন কিন্তু,তোমরা জানো না। (সুরা বাকারা: ২১৬)
-তোমাদের কী হলো,তোমরা আল্লাহর পথে অসহায় নরনারী ও শিশুদের জন্য কেন লড়ছ না,যারা দুর্বলতার কারণে নির্যাতীত হচ্ছে?তারা ফরিয়াদ করছে,হে আমাদের রব! এই জনপদ থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যাও,যার অধিবাসীরা জালেম এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য কোন বন্ধু,অভিভাবক ও সাহায্যকারী তৈরী করে দাও। যারা ঈমানদার তারা লড়াই করে আল্লাহর রাস্তায় আর যারা কাফের তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। কাজেই শয়তানের সহযোগীদের সাথে লড়ে যাও।নিশ্চিত জেনে রাখ,শয়তানের কৌশল আসলেই দুর্বল। (সুরা নিসা:৭৫-৭৬)
কখন জিহাদ ফরজ তথা আবশ্যক হয়?
অধিকাংশ ইসলামিক স্কলারের মতে নিম্নের কয়েকটি অবস্থায় জিহাদ ফরজ হয়।
প্রথমত: যখন দু’টি দল (মুসলিম ও অমুসলিম) পরস্পর মুখোমুখি হয়। যুদ্ধ ছাড়া আর কোন শান্তিপূর্ণ পথ খোলা থাকে না তখন উপস্থিত ব্যক্তিদের সেখান থেকে পলায়ন করা বৈধ নয়। তখন উপস্থিত প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য আবশ্যক হয়ে যায় দৃঢ়পদ ও অবিচল থাকা। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
-হে ঈমানদারগণ! যখন কোন দলের সাথে তোমাদের মোকাবিলা হয়,তোমরা দৃঢ়পদ থাকো এবং আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো বেশী বেশী করে। আশা করা যায়,এতে তোমরা সাফল্য অর্জন করতে পারবে। আর আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো এবং নিজেদের মধ্যে বিবাদ করো না,অন্যথায় তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দেবে এবং তোমাদের প্রতিপত্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। অতএব, তোমরা ধৈর্যধারণের পন্থা অবলম্বন কর,নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। (সুরা আনফাল: ৪৫-৪৬)
দ্বিতীয়ত: যখন শত্রুবাহিনী কোন মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর আকস্মিক আক্রমণ করে তখন নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের উপর আবশ্যক হয়ে যাবে তাদের গতিরোধ করা। তারা যদি সক্ষম না হয় তাহলে, তাদের পার্শ্ববর্তী লোকদের উপর পর্যায়ক্রমে জিহাদ ফরজ হবে।
তৃতীয়ত: রাষ্ট্রপ্রধান যখন কোন সম্প্রদায়কে জিহাদে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন তখন জিহাদে যাওয়া আবশ্যক হবে। তবে, কারও কোন ওজর থাকলে ভিন্ন কথা।
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
-হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কী হলো,যখনই তোমাদের আল্লাহর পথে জিহাদে বের হতে বলা হয়,তখনি তোমরা মাটি কামড়ে পড়ে থাক?তোমরা কি আখেরাতের মোকাবিলায় দুনিয়ার জীবনকে বেশী পছন্দ করে নিয়েছ?যদি তাই হয় তাহলে তোমরা মনে রেখ,দুনিয়ার জীবনের এমন সাজ সরঞ্জাম আখেরাতে খুবই সামান্য বলে প্রমাণিত হবে। তোমরা যদি না বের হও তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন এবং তোমাদের জায়গায় আরেকটি দলকে নিয়ে আসবেন,তখন তোমরা আল্লাহ তায়ালার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তিনি সব বিষয়ের ওপর ক্ষমতাবান। (সুরা তাওবা: ৩৮-৩৯)
-যুদ্ধ আসলে ভালো কাজ নয়; যুদ্ধ-বিগ্রহ দাংগা-হাংগামা মানুষের জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনে না। তবে, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে এটার দারস্থ হতে হয়। যখন যুদ্ধ ছাড়া সমাজকে শান্তিপূর্ণ রাখার আর কোন পথ অবশিষ্ট্য থাকেনা তখনই বাধ্য হয়ে জিহাদের চুড়ান্ত স্তর যুদ্ধের মত কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। ঠিক তেমনি আল্লাহ তায়ালা জিহাদকে পবিত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে বৈধ করেছেন।
-আর এ কাফেরদের সাথে এমন যুদ্ধ করো যেন গোমরাহী ও বিশৃংখলা নির্মূল হয়ে যায় এবং দ্বীন পুরোপুরি আল্লাহ তায়ালার জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়। তারপর যদি তারা ফিতনা থেকে বিরত হয় তাহলে আল্লাহই তাদের কার্যকলাপ দেখবেন। (সুরা আনফাল: ৩৯)
-তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকো যতক্ষণ না ফিতনা নির্মূল হয়ে যায় এবং দীন একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়। তারপর যদি তারা বিরত হয় তাহলে জেনে রাখ যালেম তথা অত্যাচারী ছাড়া আর করোর ওপর হস্তক্ষেপ করা বৈধ নয়। (সুরা বাকারা: ১৯৩)
জিহাদের উদ্দেশ্যঃ
কোন কাজ করার পিছনে কোন না কোন উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ কোন কাজ করে না। তেমনি জিহাদেরও বেশ কিছু উদ্দেশ্য আছে। সেগুলো নিম্নে উপস্থাপিত হল।
প্রথমত: আল্লাহ তায়ালার বাণী তথা বিধানকে উচ্চকিত করা। কোন স্বার্থের কারণে নয়। হাদীস শরীফে এসেছে-
-আবু মুসা আশয়ারী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসুল (সাঃ) এর কাছে একজন লোক এসে বললেন: একজন লোক যুদ্ধলব্ধ সম্পদের আশায় যুদ্ধ করে, আরেকজন নিজের নাম যশ-খ্যাতির জন্য যুদ্ধ করে এবং অন্যজন নিজের অবস্থান মানুষকে দেখানোর জন্য যুদ্ধ করে। তাদের মধ্যে কে আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় যুদ্ধ করে? রাসুল (সাঃ) বললেন: যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার বাণী তথা বিধানকে উচ্চকিত করার জন্য যুদ্ধ করে সেই আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় যুদ্ধ বা জিহাদ করে। (বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, ইবনে হিব্বান, বায়হাকী, নাসায়ী, তিরমীজি, ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ)
দ্বিতীয়ত: মজলুম তথা অত্যাচারিতদেরকে সাহায্য করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
-তোমাদের কী হলো, তোমরা কেন আল্লাহর রাস্তায় অসহায় নর-নারী ও শিশুদের জন্য লড়াই করছ না,যারা দুর্বলতার কারণে নির্যাতীত হচ্ছে? তারা ফরিয়াদ করে বলছে,হে আমাদের রব! এই জনপদ থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যাও,যার অধিবাসীরা জালেম এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য কোন বন্ধু,অভিভাবক ও সাহায্যকারী তৈরী করে দাও। যারা ঈমানদার তারা লড়াই করে আল্লাহর রাস্তায় আর যারা কাফের তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। অতএব, শয়তানের সহযোগীদের সাথে লড়াই কর এবং জেনে রাখ,শয়তানের কৌশল আসলেই দুর্বল। (সুরা নিসা:৭৫-৭৬)
তৃতীয়ত: শত্রুদেরকে প্রতিরোধ করে তাদের হাত থেকে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে হেফাজত করা। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
-হারাম (সম্মানিত) মাসের বিনিময় তো হারাম মাসই হতে পারে এবং সমস্ত মর্যাদা সমপর্যায়ের বিনিময়ের অধিকারী হবে। কাজেই যে ব্যক্তি তোমাদের ওপর হস্তক্ষেপ করবে তোমরাও তার ওপর ঠিক তেমনিভাবে হস্তক্ষেপ কর। তবে আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ, আল্লাহ তায়ালা খোদাভীরুদের সাথে আছেন (যারা সীমালংঘন করা থেকে বিরত থাকে)। (সুরা বাকারা:১৯৪)
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
-তাদেরকে নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র এ অপরাধে যে,তারা বলেছিল,“আল্লাহ আমাদের রব।” যদি আল্লাহ তায়ালা লোকদের একের মাধ্যমে অন্যকে প্রতিহত করার ব্যবস্থা না করতেন,তাহলে যেখানে আল্লাহর নাম বেশী বেশী উচ্চারিত হয় সেসব আশ্রম,গীর্জা,ইবাদাতখানা ও মসজিদ ধ্বংস করে দেয়া হত। আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন যারা তাঁকে সাহায্য করে। আল্লাহ তায়ালা বড়ই শক্তিশালী ও পরাক্রমশালী। (সুরা হজ্জ: ৪০)
জিহাদের প্রকারভেদ:
শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ বেশ কয়েক প্রকারের হতে পারে। যেমন-
১. কাফের, মুনাফিক ও মুরতাদদের সাথে যুদ্ধ।
২. ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিবর্তন আকাংখী ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
-ঈমানদারদের মধ্যকার দু’টি দল যদি পরস্পর লড়াইয়ে লিপ্ত হয়, তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। তারপরও যদি দু’টি দলের কোন একটি দল অপরটির বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করে বসে, তবে যে দল বাড়াবাড়ি করে তার বিরুদ্ধে লড়াই করো, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। এরপর যদি তারা ফিরে আসে তাহলে তাদের মাঝে ন্যায় বিচারের সাথে মীমাংসা করিয়ে দাও এবং ইনসাফ প্রতিষ্ঠা কর। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা ইনসাফ তথা ন্যায়বিচারকারীদেরকে ভালবাসেন। (সুরা হুজুরাত: ৯)
একটি হাদীসে এসেছে-
-রাসুল (সাঃ) বলেছেন: অচিরেই ফিতনা ফাসাদ ও দুর্ঘটনা ঘটবে। যে এই উম্মাতের (মুসলমানদের) মাঝে ফাটল সৃষ্টি করতে চায় সে যেই হোক না কেন তাকে তরবারী দ্বারা শাস্তি দাও (এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব)। (মুসলিম শরিফ, মুসনাদে আহমাদ)
-এই হাদিসের ব্যাখ্যায় ইসলামিক স্কলাররা বলেন: যদি কেউ ইসলামী রাষ্ট্রের মুসলমানদের ভিতর ফাটল ধরানোর ষড়যন্ত্র করে তাকে এ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিতে হবে। যদি সে বিভিন্নভাবে সতর্ক করার পরেও ক্ষান্ত না হয় তাহলে, তাকে প্রয়োজনে তরবারী দ্বারা শাস্তি দেবে। তবে,এটা রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বের আওতায় পড়ে। সরকারের কোন সবুজ সংকেত ছাড়া এটা সাধারণ মানুষ কর্তৃক বাস্তবায়নযোগ্য নয়।
৩. দ্বীন, জীবন, পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ রক্ষায় যুদ্ধ করা বৈধ। রাস্তায় সন্ত্রাসী আক্রমণ প্রহিহত করাও এ প্রকারের অন্তর্ভুক্ত।
-রাসুল (সাঃ) বলেছেন: যে তার সম্পদ হেফাজত করতে গিয়ে নিহত হয়েছে সে শহীদ, যে পরিবার পরিজনকে হেফাজত করতে গিয়ে নিহত হয়েছে সে শহীদ। যে নিজের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয়েছে সে শহীদ এবং যে দ্বীনের (ইসলামের) জন্য নিহত হয়েছে সেও শহীদ। (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, তিরমীজি, নাসায়ী, মুসনাদে আহমাদ)
জিহাদ ও যুদ্ধের পার্থক্য:
-জিহাদ ও যুদ্ধ এক জিনিস নয়। এ দু’টি ভিন্ন জিনিস। জিহাদের ভিতরে যুদ্ধ থাকতে পারে, আর যুদ্ধই জিহাদের চুড়ান্ত স্তর। তবে, যুদ্ধ সবসময় জিহাদ বলে গণ্য হয় না। জিহাদের একটি অংশ ও চুড়ান্ত স্তর হল যুদ্ধ। অন্য কথায় আমরা বলতে পারি, কিছু কিছু যুদ্ধকে জিহাদ বলা যায়, তবে সব যুদ্ধকে জিহাদ বলা যায় না। কেননা, অনেক সময় মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করা লাগে। সেটা মোটেই জিহাদ নয়।
জিহাদে নারী-শিশু বৃদ্ধ হত্যা নিষিদ্ধ:
জিহাদের ময়দানে যুদ্ধ করার অনুমতি থাকলেও নারী, শিশু ও বৃদ্ধকে হত্যা করা নিষেধ করা হয়েছে।
রাসুল (সাঃ) বলেছেন:
-আল্লাহ তায়ালার নামে এবং তারই উপর ভরসা করে রাসুল(সাঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করে অভিযানে যাও। খবরদার! কোন অতিশয় বৃদ্ধ, নারী ও শিশুকে হত্যা করবে না। সম্পদ আত্মসাৎ করবে না। তোমাদের যুদ্ধলব্ধ সম্পদ একত্রিত করবে এবং সৎকাজ করবে। আল্লাহ তায়ালা সৎকর্ম পরায়ণদেরকে ভালবাসেন। (আবু দাউদ, ইবনে আবী শায়বা, বায়হাকী)
-হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) যখন কোথাও সেনা অভিযান প্রেরণ করতেন তখন তাদেরকে বলতেন: তোমরা আল্লাহর রাস্তায় কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আল্লাহ তায়ালার নামে বের হও। খবরদার! বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, আত্মসাৎ করবে না, কারো লাশকে ছিন্নভিন্ন করবে না। ছোট্ট বাচ্চা ও কুড়েঘর ওয়ালাদের (গীর্জার পাদ্রীদের মধ্যকার যাদের দুনিয়ার দিকে খেয়াল নেই শুধু গীর্জায় অবস্থান করে) হত্যা করো না।(মুসনাদে আহমাদ, বায়হাকী)
সূত্র: ইসমাইল জাবীহুল্লাহর বই হতে।
এফ.এ.ভি.পি & ইনচার্জ
কুলাউড়া সাংগঠনিক অফিস, ১৩৯
ফারইস্ট ইসলামি লাইফ ইন্স্যুরেন্স কো:লি:
কুলাউরা, মৌলভীবাজার।