Pages

To BCS or Not To BCS?

টু বিসিএস অর নট টু বিসিএস?
সাম্প্রতিক সময়ে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাস ছাত্রছাত্রীদের ভেতরে বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে একটা দারুণ উদ্যম সৃষ্টি হয়েছে।এর ভালো এবং খারাপ দুটো দিকই আছে, আমি চেষ্টা করব একটা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরতে।

শুরুতেই বলি, এই অধম একজন বিসিএস ক্যাডার। আটাশতম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রায় ছয় বছর ধরে বাংলাদেশ পুলিশে চাকুরি করছি, বর্তমানে ডেপুটেশনে জাপানে আছি পড়াশোনা করতে।এ লেখায় নিজের জীবনের অনেক প্রসঙ্গ চলে আসবে, সে কারণে পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এ লেখাটি পড়ে আপনারা আপনাদের ক্যারিয়ার নিয়ে কিছুটা হলেও ইনফর্মড ডিসিশন নিতে পারবেন-- এটাই মূল উদ্দেশ্য। এ লেখার অনেক কিছুর সাথেই হয়ত আপনারা একমত হবেন না, এবং সেটাই স্বাভাবিক।সেক্ষেত্রে নিজের বুদ্ধি বিবেচনাকেই প্রাধান্য দিন এবং এখানে বলা কথাগুলোকে "লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি" হিসেবেই যাচাই করুন।
আমার সিভিল সার্ভিসে আসার কারণ নানাবিধ। প্রথমে কট্টর ম্যাটেরিয়ালিস্টিক কারণগুলো বলি। বাংলাদেশে মোটামুটি মান সম্মান নিয়ে থাকতে চাইলে হয় অঢেল টাকা থাকা লাগে অথবা প্রচুর ক্ষমতা থাকতে হয়- নতুবা পদে পদে লাঞ্ছিত হতে হয় সিস্টেমের কারনে। যেহেতু বিদেশে সেটেল করার ইচ্ছে নেই, সিভিল সার্ভিস আমার কাছে তাই একটা ভালো অপশন বলে মনে হয়েছে।না, ব্যবসায়ীদের মত কোটি টাকা বা পলিটিশিয়ানদের মত সীমাহীন ক্ষমতা এখানে নেই- তবে মোটামুটি চলার মত অবস্থা আছে। আমার পরিবারকে তাদের ছেলের আয়ের উপর নির্ভর করতে হয়না- এই বিশাল সৌভাগ্যটা আমার পছন্দকে আরও যুক্তিযুক্ত করেছে।

ম্যাটেরিয়ালিস্টিক কারণ বাদ দিলে যেটা থাকে- সেটা হচ্ছে রোমান্টিসিজম। খানিকটা বিব্রতভাবে স্বীকার করি- আই এ্যাম আ হোপলেস রোমান্টিক। বাবাকে দেখেছি প্রতিবার বদলী হবার সময় কিভাবে তাঁর অধীনস্ত লোকেরা কাঁদত, কিভাবে তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলে গরীব, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। "আমার মেধা ও শ্রম সরাসরি আমার দেশের কাজে লাগছে"- এই স্পেসিফিক চিন্তাটাই সিভিল সার্ভিস বেছে নিতে সহায়তা করেছে। সেই সাথে ছিল অল্প বয়েসের পাগলামি, কেভিন কস্টনারের "দি আনটাচেবলস" এর এলিয়ট নেসকে দেখে মনে হল- দিস ইজ দা লাইফ আই ওয়ান্ট!
এখনো পর্যন্ত পুলিশ সার্ভিস নিয়ে আমি নিজের কাছে সম্পূর্ন পরিতৃপ্ত। হ্যাঁ, অনেক কাজ আছে করার, পুরো ক্যারিয়ার পড়ে আছে সামনে (সব ঠিকঠাক থাকলে আরও প্রায় আটাশ বছর চাকুরি করার কথা), বলার মত কোন এ্যাচিভমেন্ট নেই-জানি। তবুও, আই এ্যাম হ্যাপি উইথ মাইসেলফ। এটাই বা কম কি!

তাহলে কি সিভিল সার্ভিস একেবারে স্বর্গের চাবিকাঠি? এটা না পেলে ইহকাল পরকাল সব তুচ্ছ?
অতি অবশ্যই না। বিসিএস নিয়ে অনেকের ভেতরে যে মোহ কাজ করে, এই মোহটা ভুল। সরকারি চাকুরি আর দশটা চাকুরির মতই একটা চাকুরি। এখানে একেবারে সাড়ে শয়তান বসে আছে কোন কোন জায়গায়, অনিয়ম আছে, দুর্নীতি আছে, বঞ্চনা আছে- আছে গ্লানি। তাহলে কেন পড়ে আছি? এমন তো না যে আর কোন অপশন নেই! আঠারো ঘন্টা অফিস করা লাগে মাসের অন্ততঃ বিশ দিন, পাবলিকের গালি খাওয়া লাগে, লাইফ থ্রেট থাকে, বসের ঝাড়ি, পোস্টিং প্রমোশন নিয়ে কামড়া কামড়ি- সবই তো আছে। তাহলে কেন?

কারণ ওই যে, হোপলেস রোমান্টিসিজম! আমি জানি, এ সার্ভিসে খুব বেশিদূর যেতে না পারার সম্ভাবনাই আমার বেশি। তবুও, ইউনিফর্ম গায়ে দিয়ে হোলস্টারে বেরেটা নাইন্টি টু পিস্তলটা গুঁজে যখন এলাকা টহল দিতে বের হই, আমার মনে হয় এ পৃথিবীতে আমি সবচাইতে সুখী মানুষ। স্কুলের পিচ্চি মেয়েটার ফোন পেয়ে যখন প্যাট্রোল টিম পাঠিয়ে ইভটিজারকে ধরে নিয়ে আসি, মাথা নিচু করে ওর মায়ের দোয়া মাথায় নিতে নিতে ভাবি- আরো তিনবার জন্ম নিলে তিন বারই আমি পুলিশ হব।

এই হচ্ছে আমার বিসিএস এর গল্প। এরকম হোপলেস রোমান্টিসিজম বুকে লালন করা পাগল যদি কেউ থাকেন,বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস আপনার জন্য। ধরে নিন প্রমোশন পাবেন না, আপনাকে ডিঙ্গিয়ে অন্য কেউ তরতর করে উঠে যাবে। সৎভাবে চললে টাকাপয়সাও খুব বেশি নেই, বিলিয়নিয়ার হবেন না নিশ্চিত। তবে সমাজের একেবারে অসহায় কিছু মানুষের উপকার করার সুযোগ পাবেন, পাবেন নিজের অবস্থান থেকে এই দুঃখিনী দেশটাকে সরাসরি কিছুটা হলেও সহায়তা করার তৃপ্তি। যদি এ দুটো নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন, মোস্ট ওয়েলকাম!

আর যদি মনে করেন হাজারটা সমস্যায় জর্জরিত সিভিল সার্ভিসের পেছনে ছোটার চাইতে অনেক ভালো কিছু করার যোগ্যতা আপনার আছে- তাতেও অন্তরের অন্ত;স্থল থেকে স্বাগত জানাই।

আপনার হয়তো যোগ্যতা আছে অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড, এমআইটির মত জায়গায় গিয়ে গবেষণা করে মানব সভ্যতাটাকেই এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবার। কেন আপনি সেটা না করে চাকুরির পিছনে ছুটবেন? প্রশ্নই আসেনা।
আপনি হয়তো প্রচন্ড বৈষয়িক এবং উদ্যমী একজন মানুষ- ব্যবসা আপনার শিরা উপশিরায় প্রবাহিত হয়। ভাই রে, অন্যের চাকর না হয়ে মালিক হোন, গর্বিত করদাতা হোন- আপনার টাকায় সিভিল সারভেন্টরা বেতন নেবে।
আপনি কর্পোরেট সেক্টর ভালবাসেন- ওটাই আপনার ধ্যান জ্ঞান। সরকারী চাকুরি আপনার পোষাতে না-ই পারে। বেশ তো! স্মার্টনেস দিয়ে তরতর করে কর্পোরেট ল্যাডার বাইতে থাকুন না! কে জানে, ইউনিলিভারের সিইও যে আপনি হবেন না, এই গ্যারান্টি কে দিচ্ছে??

স্কুলের ছোট বাচ্চাদের পড়াতে ভালবাসেন? হু গিভস আ শিট এবাউট সো কলড ম্যাটেরিয়ালিস্টিক সাকসেস? ছোট ছোট বাচ্চাদের গড়ে তুলুন, ওদের জ্ঞানচক্ষু খুলে দিন, চিন্তা করতে শেখান। কে জানে, ওদের ভেতর থেকেই হয়তো কোন মহাপুরুষ বেরিয়ে আসবে!

এই নোংরা রাজনীতি নিয়ে অসন্তুষ্ট?? বিসিএস দিয়ে সরকারী আমলা না হয়ে নিবেদিতভাবে রাজনীতি করুন- হয়ত দেখা যাবে সচিব আর আইজি স্যার দুজন মিলে একদিন আপনাকে স্যালুট দিচ্ছেন!
মূল কথা হল, "অমুকটা না হলে আমি বাঁচবোই না, আমার জীবন শেষ"- এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা। দুবার চেষ্টা করেও ফরেন সার্ভিস পাইনি, জাতিসংঘে বাংলাদেশের হয়ে কূটনৈতিক লড়াই চালিয়ে নেবার স্বপ্নটার অপমৃত্যু হয়েছে। তাতে কি? ইজ মাই লাইভ ওভার??

মোটেই না!!! হ্যাঁ, যেভাবে চেয়েছিলাম সেভাবে হয়ত হয়নি, কিন্তু জীবনটাকে প্রতি মুহুর্তে আমি উপভোগ করছি।
এই যে আজকে পুলিশের চাকুরি আছে- এটা যে থাকবেই, এরকম গ্যারান্টিই বা কে দেবে?
নেই, কোন গ্যারান্টি নেই। তাহলে?

দালাই লামার একটা কথা আছে- " যদি তুমি জান যে সমস্যার সমাধান আছে তাহলে তো হয়েই গেল- স্ট্রেস নিয়ে ফায়দা নেই। আর যদি জানো যে সমাধান নেই, তাহলে আর স্ট্রেস নিয়ে কি হবে?!"

আপনি যে পথই বেছে নিয়ে থাকেন, আপনার যাত্রা আনন্দময় হোক!
সিনিয়র এএসপি, বাংলাদেশ পুলিশ।
mashroofhossain@yahoo.com